তাসমিয়া শান্তা ও তার লেখা কিছু কবিতা; ভিডিও সহ
ছবিঃ তাসমিয়া শান্তা(সুপ্তিকা)
তাসমিয়া শান্তা ও একটি প্রতিভার সেচ্ছায় মৃত্যু....
তাসমিয়া শান্তা এক প্রাণোচ্ছ্বল তরুণী। নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছিলো তার আনাগোনা। কবিতা লিখতেন নিয়মিত।তার কবিতায় সব সময় এক তীব্র মানবিক যন্ত্রণা প্রকাশ পেত।একটু বিশ্বাস একটু ভালোবাসার চিত্র দেখা যেত।কিন্তু হঠাৎ সদ্য ফোটা ফুলটি ঝরে গেল সেচ্ছায়।আত্মসমর্পন করলেন অন্ধকারের কাছে। সেই শান্তা আর কবিতা লিখবেন না!
১৫ মার্চ, ২০১৭ এর প্রথম প্রহরে সূর্য উঠার আগ মুহূর্তে আত্মহত্যা করেছেন তাসমিয়া শান্তা। এর আগে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন নিজের লেখা কবিতা। তার সেই আবেগঘন কবিতা সবাই শেয়ার করছেন ফেসবুকে। কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করছেন, আর অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করছেন এমন আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে। এমন মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলেন না সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা।তবুও মেনেই নিতে হলো।কারন মৃত্যুর কাছে সবাই বড্ড অসহায়।সময়ের পরিক্রমায় আজ ১৫ মার্চ।এক বছর আগে এমনই একদিনে আমাদের তাসমিয়া শান্তা অভিমানী মন নিয়ে তার প্রিয় অন্ধকার জগতে পাড়ি জমায়।আজও অনেক চেনা অচেনা মানুষ তাকে স্মরণ করে।মন খারাপের সময় তাসমিয়া শান্তার ফেসবুক আই ডি টা অনেক মানুষেরই সাথি হয়। প্রায় সময় অনেকেই তার টাইম লাইনে তাকে স্মরণ করে খুব হৃদয় মোড়ানো ভালোবাসার প্রকাশ করে।যা আমাকেও খুব আবেগ তাড়িত করে।তার শেষ স্টেটাসটা ছিল একটি গানের কলি....
"আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি,
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারি"
আজ এই ফুটন্ত কবির বিভিন্ন সময়ে তার ফেসবুকে পোষ্ট করা কিছু কবিতা আপনাদের সামনে তুলে ধরে কবিকে স্মরণ করার চেষ্টা করলাম।তার প্রতিটি কবিতার লাইন আপনাকে মুগ্ধ করবে আশা করি।একজন কবির জীবনের সাথে তার কবিতার কতটুকু সম্পর্ক কবিতাগুলো পড়লেই বোঝতে পারবেন।
‘দ্বিধা’ শিরোনামের কবিতায় তাসমিয়া শান্তা লিখেছেন-
কবিতাটি ভিডিও তে দেখুন
৷৷দ্বিধা৷৷
‘যদি শারীরিক মৃত্যু শেষেও আবার ইচ্ছে হলে
পৃথিবীতে ফিরে আসা যেত,
আমি মরে যেতাম- কয়েক হাজার বার।
আমি মরে যেতাম,
যখন অন্য কাউকে তুমি প্রবল আবেগে চুমু খাও,
হাত ধরো, ভালবাসি বলো!
যখন, হুডতোলা রিকশায় বসে,
অন্যকারো চোখে পৃথিবী দেখো
তুমুল প্রেমে মাতাল হও,
যখন, অন্যকারো সমান্তরালে,
ফুটপাত ধরে হেটে যাও!
বিশ্বাস করো,আমি মরে যেতাম,
যখন অন্যকেউ তোমার জন্য শাড়ী পড়ে,
চোখে কাজল টানে, গুনগুনিয়ে গান গায়,
রাত-বিরাতে আয়না দেখে, মনের কোনায় স্বপ্ন সাজায়!
যখন তুমি অন্যকারো স্তনে মুখ গুজে
আমাকে পরিচয় করিয়ে দাও,
বোন অথবা প্রাক্তন প্রেমিকা হিসাবে।
কোন কোন সময়,
আমার বেঁচে থাকতে কি যে অসহ্য লাগে!
আমি হন্যে হয়ে মুক্তি খুঁজি, মৃত্যুর কাছে।
চোখে-মুখে কপট শৈল্পিকতা এনে,
পৃথিবীর সমস্ত পিছুটান উপড়ে ফেলি,
সম্ভাবনাময় কচি বৃক্ষের মতন।
অবশেষে, মৃত্যুর দুয়ারে কড়া নাড়তেই,
আমার তোমাকে মনে পড়ে।
আমার মনে হয়,
আজ বিকেলে খবর নেওয়া হয়নি,
ঘুমিয়েছো কিনা!
রাতের খাবার কি,
শরীরটা ভালো কিনা,
বলা হয়নি,
আজ সারাদিন কি কি করলাম,
কোথায় গেলাম,
কে ফোন দিলো,
নতুন কি দেখলাম
বলা হয়নি, আমার তোমাকেই চাই!
এখন আমি কি করবো বলো?
তোমাকে তো পেছনে ফেলতে পারি না!
অমন করে চোখে সেঁটে থাকলে
পেছনে ফেলবো কি করে বলো?
এই কথা দিচ্ছি,
একবার তোমাকে পেছনে ফেলতে পারলেই,
ভালবেসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবো, বিনা সংশয়ে।
৷৷ শঙ্খচিল৷৷
একদিন- তপ্তদুপুরে,
কোন এক নির্জন পথের বাঁকে
জীবন থেমে যাবে।
বহুদিন ধরে লাগাতার হেটে চলা ধুলোমাটির পথে-
আমার পদচিহ্নের উচ্ছেদ হবে।
এই শহরের আলপথ ধরে,
বাবার সাথে গুটিগুটি পায়ে হেটে যাওয়ার গল্প
থেমে যাবে।
ঐ বারান্দায় দাঁড়িয়ে,
একজোড়া নতুন জুতোর জন্য মায়ের সাথে তুমুল
ঝগড়ার কথা ভুলে যাবো।
ভুলে যাবো-
ঐ গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে,
একদল বখাটের সাথে ভাগাভাগি করে এক প্লেট
ফুসকা খাওয়ার গল্প।
শীতের সকালে,
উষ্ণতার লোভে আঁকড়ে ধরা প্রেমিকের গালে,
ফাল্গুনে এসে টুক করে চুমু খাওয়ার গল্প ভুলে
যাবো।
চৈত্রের কাঠফাটা রোদে তুমুল ঝগড়া শেষে,
বৈশাখের ঝড়ো হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া প্রেমের
কথাও ভুলে যাবো।
আরো ভুলে যাবো
আমার অনুসন্ধিৎসু মনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা সমূহ!
স্বপ্ন ময়ূরের ডানায় চেপে দূর মেঘমালার দেশে
হারিয়ে যাবে আমার সমস্ত কারুকার্যময় দীর্ঘশ্বাস।
এবং আমার প্রেমের বারান্দায় মাকড়শা'র দল জাল
বুনবে- শৈল্পিক দক্ষতায়।
দু'হাতে ইচ্ছামৃত্যুরর তাজাফুল নিয়ে,
প্রতিশ্রুতিরর স্ট্যাম্প পেপারে আমার একটা জীবন
লিখে দিব-মৃত্যুর নামে।
তারপর মৃত্যুর অবিশ্বাস্য ভালোবাসায়
আমি ভুলে যাব সমস্ত জাগতিক অভিলাষ।
আমি চলে যাবো-
পাহাড়ের ঘন সবুজে লেপ্টে থাকা গোধূলির
রক্তিম আভা ছুঁয়ে,
সুমুদ্রের জলে সূর্যাস্তের মনোমোহন,
চিত্তাকর্ষক দৃশ্য উপেক্ষা করে, দূরে..বহুদূরে!
পৃথিবী ফিকে হতে হতে তলিয়ে যাবে- গাঢ়
অন্ধকারে!
ক্রমাগত আলোর বারিধারায় আমার ঝলসে যাওয়া
চোখ জোড়া মাথা নিচু করে ঈশ্বরের প্রতি
কৃতজ্ঞতা জানাবে, একটুখানি স্বস্তির জন্য।
অবশেষে এক নিপুণ প্রক্রিয়ায় সমাপ্ত হবে আমার
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া!
এবং আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনবদ্য মধুর কম্পনে,
গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া পৃথিবী ফের জাগ্রত
হবে।
তারপর-
আমার বিনাশপ্রাপ্ত শব ভস্ম পৃথিবীকে বিদায় জানাতে
গিয়ে,
সুমুদ্র পিঠে সুতীব্র উল্লাসে একজোড়া
শঙ্খচিলের উড়াউড়ি দেখে
আবার প্রবেশ করবে পৃথিবীমুখে।
পরিবর্তিত রুপ নিয়ে!
একটা সতেজ বৃক্ষ,
অথবা শহুরে আলপথ
কিংবা একজোড়া শঙ্খচিল হয়ে।
||ব্যক্তিগত তুমি||
তুমি আমাকে ছুঁয়ে যাও,
দখিনা বাতাসের মতন পরম আবেশে।
নির্মল অধিকারের ছলে আমি দাবি করি,
তোমার সমস্ত কিছু আমার ব্যক্তিগত!
রোমকূপ থেকে রক্তনালী,
হৃৎপিন্ড থেকে আত্মার বিচ্ছিন্ন অংশ সমস্ত।
আমি জন্মাবধি স্বার্থপর
এবং স্বৈরাচারী প্রেমিকা!
শিউলি ফুলের পাপড়িতে লেগে থাকা
একবিন্দু শিশিরের মতন,
আমি লেপ্টে থাকতে চাই
তোমার সমস্ত সত্ত্বায়!
আমি তোমাকে ভাবলেই-
সহসা কুয়াশা ফুড়ে তীক্ষ্ণ
সূর্যরশ্মি ঢুকে পড়ে,
আমার ব্যক্তিগত বাগানে!
আমার গগন অরণ্যে ঘুরে বেড়ায়,
প্রেম রঙা এক চঞ্চলা পাখি!
প্রিয়ত, চলো এবার ,
বিলুপ্তপ্রায় ভালবাসার
কাধে হাত রেখে,
নিশ্বাসে প্রেমের গন্ধ ছড়িয়ে
আমরা নিয়তি ভাঙি।
|| বিশ্বস্ত ভাবনা ||
তুমি দেখে নিও,
আমার এই অসুখী চোখ জোড়ার
অসহায়ত্বের কথা ভেবে
কোন এক মাঝরাতে তোমার ঘুম ভেঙে যাবে।
সে রাতে তুমি আর ঘুমোতে পারবে না।
তোমার চারপাশে,
ঘুরেফিরে খুঁজবে আমাকে।
আমার অভাবে সেই সকালটা
মৃদ্যু যন্ত্রণাময় হবে তোমার।
আমার চোখের ভেতরকার
এইসব অসহায়ত্ব জেঁকে বসবে,
তোমার বুকের ভেতর।
তুমি খুঁজবে এই চোখ,
এই অসুন্দর মুখ।
এই চিবুক ,
তোমার নামে দলিল করে দেওয়া-
আমার বুক।
কখনো কখনো খুঁজবে,
আমার মতন একজোড়া বিশ্বস্ত হাত।
প্রচন্ড রাগের শেষে,
রাগটুকু ঝেড়ে ফেলতে,
যাচ্ছে তাই বলে গালি দেবার জন্য
আমাকেই মনে পড়বে তোমার।
মন খারাপের এক বিকেলে,
আমার কাধের
অথবা বুকের তীব্র অভাববোধে
তুমি নিঃশব্দে কাঁদবে।
কোন কোনদিন,
এই অসুন্দর ঠোঁটে
চুমু খেতে ইচ্ছে করবে তোমার।
তুমি পৃথিবী সুদ্ধ মানুষের মাঝে
খুঁজবে আমাকে-পাগলের মতন।
এই সমস্ত বিশ্বস্ত ভাবনা নিয়ে,
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ হয়ে
একদিন আমি মরে যাবো।
অস্বীকৃতি কবিতাটি ভিডিও তে দেখুন
|| অস্বীকৃতী ||
এই অন্ধকারে লুটিয়ে পড়া বিষণ্ন রাতগুলোয়
তুমি নেই।
কিছু ঘন গভীর দীর্ঘশ্বাস আছে কেবল।
সেও আমার একার।
ঈশ্বর বলেছে,
কেউ কারো দীর্ঘশ্বাসের
শব্দ শুনতে পায়না।
তবু আমি ভাবতাম,
তুমি বোধয় শুনতে পাও।
এত কাছে থেকেছো,
বুকের এত গভীরে
তবু আমার এত দীর্ঘ,
স্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস শুনতে পাওনি,
তা আমার বিশ্বাস হতো না।
আচ্ছা, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছো?
ওইযে, তোমার পাশে হাটতে হাটতে-
বড় অচেনা এক নদীর সামনে এসে
যখন তুমি থেমে গেলে,
যখন তোমার অবয়বে স্পষ্ট হলো,
ক্লান্তি আর হতাশার ছাপ!
বড্ড দরকারেও যখন সেই বড় দীর্ঘ নদী পার হবার
আর কোনও উপায় ছিল না তোমার,
তখন যে অবাধ্য কিশোরী
সাঁকোর রুপ ধারন করলো,
শরীর এলিয়ে-
সেই আমি!
তুমি তো কেবল দরকারে আমাকে মারিয়ে গেছো,
চিনবে কি করে?
কতবার বললাম,
দাঁড়াও একটু, একসাথে হাঁটি।
তুমি শুনলে নাতো!
কী, এখনো চিনতে পারোনি তো?
তবে থাক, আর চিনতে এসো না।
আমাকে চিনতে পারোনি,
এ তোমার সাতজন্মের ভাগ্য গো!
আমাকে চিনলে,
তুমি আর বাঁচতে পারবে না।
মরে যাবে...
মরে যাবে আমার ঘন গভীর দীর্ঘশ্বাসে।
আরো মরে যাবে,
আমাকে ভালবাসতে না পারার আক্ষেপে!
আমি নারী।
আমি প্রেমিকা।
আমি উত্তাল নদীর বুকে অবহেলায় পড়ে থাকা সাঁকো!
আমাকে চিনতে এসো না
আমাকে একবার চিনলে আর উপেক্ষা করতে পারবে না।
তাসমিয়া শান্তা পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্রী ও চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের ধুলাউড়ি গ্রামের মেয়ে।মাত্র ২০ বছর বয়সে সেচ্ছায় দেহ ত্যাগ করেন তাসমিয়া। মানবিক এক সম্পর্ক ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে তাকে এ পথ বেঁচে নিতে হয়।একটি পবিত্র ভালোবাসার এই পরিনতি বরণ করে নিতে হয় ।তার বিশ্বাসের সাথে তার জীবনটাও ভেঙ্গে গেছিল এই পৃথিবীতে।চারপাশের ডিপ্রেশনগুলো চেঁপে ধরেছিল হাসিখুশি এই মেয়েটিকে।যদিও তাসমিয়া কাউকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেনি।তবুও তার মৃত্যুর জন্য অনেকেই দায়ী।সেচ্ছায় মৃত্যুগুলোর জন্য আপন মানুষরাই সাধারনত দায়ী হয়ে থাকে। আজ আর সেদিকে গেলাম না।তবে আমাদের উচিত পাশের পরিচিত মানুষগুলির একটু খেয়াল রাখা।একটু যত্ন নেয়া।কেমন আছে খবর নেয়া।হয়তো আপনার আমার একটু কেয়ার বাঁচিয়ে দিবে তাসমিয়াদের মত হাজারো প্রতিভাকে।আসুন আমরা আর আমাদের প্রিয় মানুষগুলোকে অসময়ে হারাতে না দেই।ফেসবুকের ছোট ছোট স্টেটাস গুলোকে আবেগ বলে উড়িয়ে না দিয়ে একটু গরুত্ব দেই।ভেঙ্গে যাওয়া মানুষগুলো কে টেনে তুলি।স্বপ্নহীনকে একটু স্বপ্ন দেখাই।বিচ্যুত কে একটু পথ দেখাই।শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে নিঃসঙ্গ মানুষগুলোকেও সময় দেই।
ভালো থেকো তাসমিয়া তোমার অন্ধকারের শহরে।ভালো থেকো তোমার একাকীত্বের শহরে।কালের পরিক্রমায় হয়তো অনেকে তোমায় ভুলে যাবে।এর মাঝেও কিছু মানুষ তোমায় যুগযুগ ধরে মনে রাখবে।তোমার কথা ভাববে সময় অসময়ে।আর আমি যেন তাদেরই একজন হই................
সংকলনেঃনাঈম আজিজ চৌধুরী(শিক্ষার্থী,বিশ্ববিদ্যালয়)
তথ্য ও ছবি সংগ্রহঃ তাসমিয়ার ফেসবুক আইডি ও গুগল






No comments